ইরানে তৈরি 'সিনা' রোবোটিক সার্জারি সিস্টেম বিশ্বের অন্যতম উন্নত সার্জিক্যাল রোবট। তেহরানে ইরানের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি মেলা বা ইনফোটেক্স ২০১৫-এ এই রোবটের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছিল। এই রোবটটির নকশা ও নির্মাণের মাধ্যমে ইরানের প্রকৌশলীরা অতি উন্নত ও অত্যাধুনিক এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে প্রবেশ করেন। ইরানি বিজ্ঞানীদের এই রোবট তৈরির আগে আমেরিকার তৈরি 'দ্যা ভিঞ্চি' ছিল বিশ্বের একমাত্র বাণিজ্যিক সার্জিক্যাল রোবট। ইরানের ইতিহাসের বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক বু আলী সিনার নাম অনুসারে ইরানের তৈরি এই রোবটটির নাম রাখা হয়েছে 'সিনা' রোবোটিক সার্জারি ।
'সিনা' রোবোটিক সার্জারির কার্যক্রম
'সিনা' রোবোটিক সার্জারি সিস্টেম তেহরানের শরিফ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং তেহরান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে তৈরি করেছিল। এ রোবটটি মূলত একটি অত্যাধুনিক রিমোট বা টেলি সার্জারি ব্যবস্থা। একটি মনিটর এবং রোবট নিয়ন্ত্রিত দু’টি বাহুর ভিত্তিতে কাজ করে ইবনে সিনা রোবোটিক সার্জারি । সার্জিক্যাল কনসোলে একটি মনিটর, দুটি গাইডিং রোবট এবং ফুট কন্ট্রোল প্যাডেল রয়েছে, যেখানে সার্জন এটির পিছনে বসে অপারেশন এলাকা থেকে পাঠানো ছবিগুলো দেখেন এবং অস্ত্রোপচারের সরঞ্জাম এবং ইমেজিং ক্যামেরাকে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তলপেট এবং প্রোস্টেট অপারেশনসহ আরো অনেক কাজে এ রোবট ব্যবহার করা যাবে। এ যন্ত্রের মাধ্যমে অপারেশন করলে রোগীদেহের স্বাস্থ্যকর কোষকলার ক্ষতি এবং রক্তপাত কম হবে। এতে রোগীর সেরে ওঠার প্রক্রিয়া দ্রুততর হবে। অন্যদিকে, তিনটি ফলোয়ার রোবট, যার মধ্যে দুটি টুল বহনকারী রোবট এবং একটি ছবি তোলার রোবট যা রোগীর শয্যার পাশে অবস্থান কোরে, এরা চিকিৎসকের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে।
অপারেশন চলাকালীন সময়ে এটি কমপ্যাক্ট লিনিয়ার এক্সিলারেটর নিয়ে গঠিত এমন একটি মেশিন যা একটি বিকিরণ রশ্মি তৈরি করে এবং এটি একটি চালিত রোবোটিক হাতের সাথে সংযুক্ত। মেশিনের রোবোটিক যন্ত্রপাতিগুলো রোগীর শয্যার চারপাশে ঘোরাফেরা করে। অপারেশন প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে, রোগী একটি বিছানায় শুয়ে থাকবে এবং মেশিনের রোবোটিক বাহু তার শরীরের চারপাশে ঘুরবে এবং উচ্চ মাত্রার বিকিরণ সরাসরি তাদের টিউমার বা অন্য কোনো ক্ষত স্থানে পৌঁছে দেবে। রোগীর বিছানার নিচে থাকা রোবট এবং সার্জিক্যাল কনসোলে কাজ করা রোবটগুলোর মধ্যে সংযোগ ইন্টারনেটের মাধ্যমে বজায় থাকে। তাই অস্ত্রোপচারের কাজ বহু দূর থেকেও সম্পন্ন করা যায়।
বিশ্ববাজারে ইরানের উপস্থিতি
ইরানের তৈরি 'সিনা' রোবোটিক সার্জারি সিস্টেমের প্রথম রপ্তানি চালান ছিল ফ্লেক্স মডেলের যা ২০২১ সালে ইন্দোনেশিয়ায় রপ্তানি করা হয়েছিল। ইন্দোনেশিয়ায় 'সিনা' রোবোটিক সার্জারি সিস্টেম এমন সময় রপ্তানি করা হয়েছিল যখন এই দেশটি এর আগে আমেরিকার তৈরি দ্যা ভিঞ্চি রিমোট সার্জিক্যাল রোবট সিস্টেম ব্যাবহার করতো।দ্যা ভিঞ্চি রোবটটি অনেক দামি হওয়ায় অস্ত্রোপচারের জন্য তা এই মুহূর্তে ইন্দোনেশিয়ায় ব্যবহার করা হচ্ছে না। কিন্তু ইরানের তৈরি সিনা রোবোটিক সার্জারি সিস্টেম দামে অনেক সস্তা হওয়ায় ইন্দোনেশিয়ান সার্জনরা অবাক হয়েছিলেন। এ কারণে ইরানের তৈরি রোবোটকে স্বাগত জানান। ইরানের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও মেডিকেল শিক্ষামন্ত্রী 'বাহরাম আইনোল্লাহি' জানিয়েছেন, ইন্দোনেশিয়া তার নতুন প্রতিষ্ঠিত অনেক হাসপাতালকে ইরানে উৎপাদিত চিকিৎসা সরঞ্জামাদি দিয়ে সজ্জিত করতে চায়।
যাইহোক, ইরানের তৈরি এই পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি অর্জন করেছে। এ কারণে বিশ্ব বাজারে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছে দেশটির সরকার। এসব উদ্যোগের মধ্যে, রাশিয়ান সেন্ট্রাল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট ইন রোবোটিক্স অ্যান্ড সাইবারনেটিক টেকনোলজিস (আরটিসি) এর সাথে ইরানের তৈরি এই সিস্টেমের যৌথ উত্পাদন চুক্তির কথা উল্লেখ করা যায়। এই চুক্তি অনুসারে, 'সিনা' সার্জিক্যাল রোবটটির অর্ধেক অংশ ইরানে উত্পাদিত হবে এবং এসকেডি হিসাবে রাশিয়ায় রপ্তানি করে সেন্ট পিটার্সবার্গে তা এসেম্বলি করে পরিপূর্ণভাবে তৈরির কথা রয়েছে। এরপর রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত 'ইরানি-রাশিয়ান যৌথ কোম্পানি' রাশিয়া ও সিআইএসভুক্ত এলাকায় এই সিস্টেমের মার্কেটিং, বিপণন, বিক্রয় এবং বিক্রয়োত্তর পরিষেবা পাওয়ার বিষয়ে কাজ করবে। এ ছাড়া, ইরান ইউরোপীয় বাজারেও প্রবেশের চেষ্টা করছে। ফেডারেল পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটি অফ লুজান (EPFL) এর সাথে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে এবং খুব ভাল সহযোগিতামূলক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ইরানের সিনা কোম্পানি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প অংশীদার হিসাবে নিবন্ধিত হয়েছে।