ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার সরকারি খাদ্য গুদামগুলোতে চলছে প্রকাশ্য ‘বদলি বাণিজ্য’। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কর্মকর্তাদের চাপ দিয়ে ‘পারিবারিক সমস্যা’ দেখিয়ে বদলি করা হচ্ছে। পরে মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে সেখানে নতুন কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, ময়মনসিংহ আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক আশরাফুল আলমের নেতৃত্বে গঠিত একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট এই বদলি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি অন্তত ছয়টি গুদামে এ ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। পুরো প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতার দায়িত্ব পালন করছেন খাদ্য পরিদর্শক মো. মাজহারুল ইসলাম কামাল।
খাদ্য অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, আঞ্চলিক অফিস থেকেই কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ‘পারিবারিক সমস্যা’ দেখিয়ে আবেদন লিখিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কেউ অস্বীকৃতি জানালে প্রশাসনিক জটিলতায় ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
এসব বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হচ্ছে বলে দাবি কর্মকর্তাদের।
জানা গেছে, নেত্রকোনার কেন্দুয়া সদর খাদ্য গুদামে সম্প্রতি বিধিবহির্ভূতভাবে এক উপপরিদর্শককে পরিদর্শকের দায়িত্বে পদায়ন করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী সেখানে পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকার কথা। এ নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর বাধ্য হয়ে সেই পদায়ন আদেশ বাতিল করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া নেত্রকোনা সদর, ঠাকুরাকোনা, ময়মনসিংহের গৌরীপুর, তারাকান্দা, ধলা ও শ্যামগঞ্জ গুদামে দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই অনেক কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে একই কর্মকর্তাকে অল্প সময়ের মধ্যে দুইবার বদলি করা হয়েছে।
তারাকান্দা খাদ্য গুদামের কর্মকর্তা মো. আলাল হোসেনকে গত ১৯ আগস্ট মেয়াদ পূর্ণের দুই মাস আগেই বদলি করে ফুলবাড়িয়ায় পাঠানো হয়। মাত্র ১৭ দিনের ব্যবধানে তাকে ফের গৌরীপুরে বদলি করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আলাল হোসেন মোবাইলে প্রতিবেদককে বলেন, “আপনি একসময় আমার অফিসে আসেন, একটু বসে কথা বলব।
” ১৭ দিনের ব্যবধানে দুইবার বদলীর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান।
একইভাবে গত ২২ অক্টোবর বদলি করা হয় নেত্রকোনা সদর গুদামের কর্মকর্তাকে। নেত্রকোণার ঠাকুরাকোণা এলএসডিতে দায়িত্বে থাকা শামিম আহম্মেদ পারিবারিক সমস্যা দেখিয়ে সেই এলএসডিতে মিউচুয়াল ট্রান্সফারের মাধ্যমে আব্দুল ওয়াহাবকে সুযোগ করে দিয়েছেন বলে জানান খাদ্য পরিদর্শক মো. মাজহারুল ইসলাম কামাল। তবে নিয়মানুযায়ী মিচুয়াল ট্রান্সফারের কোনো সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শামিম আহম্মেদ জানান, আমার পারিবারিক সমস্যার কারণে দীর্ঘদিন যাবত বদলির চেষ্টা করছিলাম। নিয়মানুযায়ী বদলি হয়েছি। কোনো মিচুয়াল ট্রান্সফার করিনি।
বদলি বাণিজ্যের এই অনিয়মে ক্ষুব্ধ মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ঘুষ ছাড়া এখন কোনো পদায়নের সুযোগ নেই। ফলে দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাদ্য অধিদপ্তরের এক পরিদর্শক জানান, এসব অনিয়ম প্রশাসনের জ্ঞাতসারে ঘটছে। কিন্তু কেউই প্রকাশ্যে কথা বলতে চাইছেন না।
এসব বিষয়ে জানতে ময়মনসিংহ আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক আশরাফুল আলমকে একাধিকবার মোবাইল কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। খাদ্য পরিদর্শক মো. মাজহারুল ইসলাম কামাল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “যাদের বদলির অর্ডার হয়েছে তারা কি কেউ আপনাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছে? আমাদের বিপক্ষে কিছু গ্রুপ আছে, তারা এসব মিথ্যা ছড়াচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের আরসি ফুড স্যার খুব ভালো মানুষ। কেউ তার দুর্নীতির প্রমাণ করতে পারবে না। আমি যেহেতু নেতৃত্ব দেই, সবাই আমার কাছে আসে। আর বদলিগুলো আরসি ফুড চাইলেও অনেক সময় নিজে করতে পারেন না; অনেক তদবির থাকে। আরসি ফুড স্যার আমাকে বলেছেন আপনি ফোন দিয়েছিলেন। উনি অনেক সময় ফোন ধরেন না।
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীরকে অফিসিয়াল নাম্বারে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
খাদ্যসচিব মো. মাসুদুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, একসঙ্গে এত জনের পারিবারিক সমস্যা রহস্যজনক। বদলি বাণিজ্যের বিষয়ে তদন্ত করে প্রমাণ মিললে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নিউজ ডেস্ক
সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন