‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ আশ্রমের চেয়ারম্যান ও প্রতিষ্ঠাতা মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে মানব পাচারের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় চার দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। আজ রোববার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম শান্তা আক্তার রিমান্ডে নেওয়ার এই নির্দেশ দেন।
আজ দুপুরের পর মিল্টন সমাদ্দারকে মৃতদের জাল মৃত্যুসনদ দেওয়ার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তিন দিনের রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ কামাল হোসেন তাঁকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। শুনানি শেষে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতাউল্লাহ তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
আদালতের প্রসিকিউশন দপ্তরের মিরপুর থানার নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) সাইফুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
অন্যদিকে মানব পাচার আইনে দায়ের করা মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক শিকদার মাইতুল আলম মিল্টনকে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন। ওই আবেদন শুনানির জন্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম শান্তা আক্তারের আদালতে হাজির করা হয়। মিল্টন সমাদ্দারের পক্ষে রিমান্ড বাতিলের আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আদালতের প্রসিকিউশন দপ্তরের মিরপুর থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা এসআই জালাল উদ্দিন মিল্টনকে জাল মৃত্যু সনদ ইস্যুর মামলায় কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
গত বৃহস্পতিবার মিল্টনকে জাল মৃত্যু সনদ ইস্যু করার মামলায় তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এর আগে গত বুধবার সন্ধ্যায় মিরপুর থেকে মিল্টন সমাদ্দারকে আটক করে পুলিশ। এরপর তাঁকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। পরে বৃহস্পতিবার ভোররাতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জালজালিয়াতির মাধ্যমে মৃত্যুর সনদ তৈরি করে খাঁটি হিসেবে ব্যবহার করার অপরাধে ডিবির এসআই মো. কামাল পাশা মিরপুর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় মিল্টন সমাদ্দারের সহযোগী হিসেবে কিশোর বালাকে আসামি করা হয়। মামলায় কিশোর বালাকে পলাতক দেখানো হয়েছে।
মামলায় বলা হয়েছে, গত ২৪ এপ্রিল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও একটি দৈনিক পত্রিকা এবং গণমাধ্যমে ফলাওভাবে ‘মানবতার ফেরিওয়ালার অত্যাচার/মারামারি’ শীর্ষক সংবাদ প্রচার হতে থাকে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বিষয়টি অনুসন্ধান ও তদন্তকালে ১ মে রাত ৮টার সময় রাজধানীর দক্ষিণ পাইকপাড়ায় মিল্টন সমাদ্দারের চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার সেন্টারে পুলিশ ফোর্স নিয়ে হাজির হয় ডিবি পুলিশ। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মিল্টন সমাদ্দার পালিয়ে যেতে উদ্যত হলে তাঁকে আটক করা হয়। তাঁর সহযোগী কিশোর বালা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, আটকের পর মিল্টন সমাদ্দার স্বীকার করেন, তিনি কোনো নিবন্ধিত ডাক্তার নন। তাঁর প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধিত কোনো ডাক্তারকে নিয়োগ প্রদান করেননি। তিনি চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সেবার নামে নিজে ডাক্তার সেজে পলাতক আসামির সঙ্গে পরস্পর যোগসাজসে প্রতারণামূলকভাবে বিভিন্ন চিকিৎসা করে, সেবা করে, ক্রিয়েটিভ কনটেন্ট তৈরি করে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমোর মাধ্যমে ১ কোটি ২০ লাখ ফ্রেন্ড-ফলোয়ারের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে প্রতারণামূলকভাবে অর্থ উপার্জন করেন। পরে আসামি মিল্টন সমাদ্দারের টেবিল থেকে ৫০টি মৃত্যুসনদ উদ্ধার করা হয়। এই সনদগুলোতে নিজে স্বাক্ষর দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর কাছ থেকে দুটি স্ট্যাম্প সিল উদ্ধার করা হয়।
মামলায় আরও অভিযোগ করা হয়, মিল্টন সমাদ্দার দীর্ঘদিন ধরেই মানবতার সেবা ও চিকিৎসা নামে বিভিন্ন বয়স্ক ও শিশুকে নিয়ে শারীরিক-মানসিক আঘাত করে কখনো কখনো তাদের সুচিকিৎসার নাম করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে বিক্রি করেন। তিনি শিশু পাচার করেন বলেও জানা যায়। তাঁকে আটকের পর বৃহস্পতিবার জালজালিয়াতির মাধ্যমে মৃত্যুসনদ তৈরি করার অভিযোগে মামলা দায়ের ছাড়াও মানব পাচার এবং বেআইনিভাবে অন্যকে আটক রেখে খুনের চেষ্টার অভিযোগে আরও দুটি মামলা মিরপুর থানায় দায়ের হয়।
মানব পাচার মামলা
মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে দায়ের করা মামলার বাদী এম রাকিব। তিনি মামলায় উল্লেখ করেছেন, ২০২০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলের সামনে দুই বছরের এক শিশুকে পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। তখন শেরেবাংলা নগর থানায় বিষয়টি জানান। কিন্তু থানা-পুলিশ কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারে ফোন করলে মিল্টন সমাদ্দার ওই শিশুকে সেখান থেকে নিয়ে যান।
বাদী এম রাকিব এজাহারে আরও উল্লেখ করেন, তিনি অভিভাবক হয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে ১০ হাজার টাকা দেন এবং শিশুটিকে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারে ভর্তি করান। এরপর মিল্টন সমাদ্দার রাকিবকে জানান, আদালতের মাধ্যমে শিশুটিকে দত্তক নেওয়া যাবে।
এজাহারে বাদী আরও উল্লেখ্য করেন, ২০২১ সালের কোনো একদিন মিল্টন ফোন করে তাঁকে বলেন,‘ আমি (রাকিব) যেন ওই প্রতিষ্ঠানে আর না যাই এবং শিশুটির খোঁজখবর না নেই। এরপর আরও বেশ কয়েকজন ফোন করে আমাকে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখান। প্রাণভয়ে আমি আর সেখানে যাইনি। সম্প্রতি একটি খবর চোখে আসার পর গত ২৪ এপ্রিল চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারে যাই। কিন্তু শিশুটিকে সেখানে পাওয়া যায়নি। শিশুটি কোথায় আছে, সে ব্যাপারেও তাদের কাছ থেকে সদুত্তর পাওয়া যায়নি।’ বাদীর অভিযোগ, ২০২১ সালের যেকোনো সময় শিশুটিকে পাচার করা হয়েছে।
যে কারণে রিমান্ডের আবেদন
মানব পাচার মামলায় রিমান্ডের আবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, বাদীর এজাহারে বর্ণিত শিশুটি কোথায় আছে বা আদৌ আছে কি না বা পাচার করা হয়েছে কি না এবং শিশুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করা হয়েছে কি না, সেসব তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। জানা গেছে, এ রকম অনেক শিশু পাচারের সঙ্গে মিল্টন সমাদ্দার জড়িত। এসব অভিযোগের তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য তাঁকে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।