ঢাকা | |

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সংকট দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে

ফেনী জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ঘাটতি দিনদিন তীব্রতর হচ্ছে। নানা প্রচেষ্টা চালিয়েও ভর্তির হার বাড়ানো যাচ্ছে না।
  • আপলোড সময় : ২১ মে ২০২৫, দুপুর ১০:২০ সময়
  • আপডেট সময় : ২১ মে ২০২৫, দুপুর ১১:২৮ সময়
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সংকট দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে

ফেনী জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ঘাটতি দিনদিন তীব্রতর হচ্ছে। নানা প্রচেষ্টা চালিয়েও ভর্তির হার বাড়ানো যাচ্ছে না। শিক্ষকরা মনে করছেন, অভিভাবকদের মাদরাসা ও কিন্ডারগার্টেনমুখী আগ্রহ এর মূল কারণ। অন্যদিকে অভিভাবকরা বলছেন, সরকারি বিদ্যালয়ের চেয়ে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানের মান উন্নত হওয়ায় তারা বিকল্পমুখী হচ্ছেন।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জেলার ৫৩৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৮০টিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১০০-এর নিচে। এর মধ্যে ১২টি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে ৫০-এরও কম। এসব বিদ্যালয়ে ৩ থেকে ১২ জন শিক্ষক কর্মরত থাকলেও মানসম্পন্ন পাঠদানের বিষয়ে অভিভাবকদের উদ্বেগ রয়েছে। সরেজমিনে এসব বিদ্যালয়ের চিত্র আরও উদ্বেগজনক।

২০২৫ শিক্ষাবর্ষে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মোট ভর্তি হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৯৪৬ জন শিক্ষার্থী, যা আগের বছরের তুলনায় কমেছে ১১ হাজার ৬২৪ জন। তবে উপজেলা পর্যায়ের হিসাব অনুসারে, ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৭২ হাজার ৭৯৫ জন, ফলে ৯৯ হাজার ১৫১ শিক্ষার্থীর সংখ্যাগত পার্থক্য দেখা যাচ্ছে।

উপজেলা ভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সদর উপজেলায় কেন্দ্রীয় হিসাবে শিক্ষার্থী ৭৪ হাজার ৪৮১ জন হলেও উপজেলা হিসাবে তা মাত্র ২৩ হাজার ৩৮৪ জন। একইভাবে অন্য উপজেলাগুলোতেও তথ্যের বিশাল ফারাক পরিলক্ষিত হচ্ছে।

জেলার বিভিন্ন বিদ্যালয় পরিদর্শনে দেখা গেছে, অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আশঙ্কাজনকভাবে কম। যেমন ফুলগাজীর দেবীপুর ফেরদৌস আক্তার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ২২ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে, তাও তৃতীয় শ্রেণির কেউ নেই। সোনাগাজীর পূর্ব বড়ধলী বিদ্যালয়ে পাঁচটি শ্রেণিতে মাত্র ২৭ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।

অভিভাবক মনোয়ারা বেগম জানান, তিনি মেয়েকে স্থানীয় এক কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করেছেন কারণ সেখানে পাঠদান ভালো হয় এবং ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ রয়েছে, যা সরকারি বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত।

ফুলগাজীর একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জীবন চন্দ্র দাস জানান, বিদ্যালয়ে মাত্র তিনজন শিক্ষক কর্মরত, দূরবর্তী অবস্থানের কারণে শিক্ষকরা যোগদান করতে অনীহা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, অভিভাবকরা মাদরাসা ও কিন্ডারগার্টেনের দিকে ঝুঁকছেন।

প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় মহাসচিব মহিউদ্দিন খন্দকার বলেন, ধর্মীয় শিক্ষকের অনুপস্থিতি, পাঠ্যবই নিয়ে মতানৈক্য, এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার শিক্ষার্থী সংকটের মূল কারণ। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের মনোযোগে প্রভাব পড়ে।

সোনাগাজী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম তাহেরুল ইসলাম বলেন, উপকূলীয় চরাঞ্চলে শিশুরা পরিবারের কাজে যুক্ত হয় এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেকেই মাদরাসামুখী হয়। তিনি জানান, শিক্ষার্থী বাড়াতে নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালানো হচ্ছে।

সুজন ফেনীর সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন জানান, সচ্ছল পরিবারগুলো ব্যয়বহুল বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তি করাচ্ছে। সরকারি বিদ্যালয়ের পাঠদানের মানে উন্নয়ন না ঘটলে শিক্ষার্থী সংখ্যা আরও হ্রাস পাবে।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ফিরোজ আহম্মদ বলেন, করোনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এবং স্থানীয় মক্তব বন্ধ হওয়ায় মাদরাসামুখী প্রবণতা বেড়েছে। পাশাপাশি তথ্যগত বিভ্রান্তি প্রসঙ্গে তিনি জানান, বইয়ের চাহিদা মেটাতে প্রাথমিকভাবে জেলা তথ্য তৈরি করা হয়েছে, উপজেলা পর্যায়ের পূর্ণাঙ্গ তথ্য এখনও সংগ্রহাধীন।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) ফাতিমা সুলতানা জানান, সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ঘাটতি উদ্বেগজনক। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।

জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী, একজন শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থীর অনুপাত ৩০ জন হওয়ার কথা। দেশে এই অনুপাত বর্তমানে ১:২৯ হলেও মানসম্মত শিক্ষক, প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামোর ঘাটতি এখনও রয়ে গেছে।

১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার বিদ্যালয় এবং ২০১৩ সালে আরও ২৬ হাজার বিদ্যালয় জাতীয়করণের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষাকে শক্তিশালী করা হলেও অভিভাবকদের আস্থা ফেরাতে তা যথেষ্ট নয়। উপবৃত্তি, মিড-ডে মিল, বিনামূল্যে বইসহ নানা প্রকল্প চলমান থাকা সত্ত্বেও সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকট বেড়েই চলেছে।

নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০-এর নিচে হলে বিদ্যালয় একীভূত করার কথা রয়েছে। তবে একটি শিক্ষিত জাতি গঠনে প্রাথমিক শিক্ষাকে কার্যকর ও মানসম্পন্ন করা ছাড়া বিকল্প নেই।

  • বিষয়:

নিউজটি আপডেট করেছেন: স্টাফ রির্পোটার।

বাংলা নিউজ নেটওয়ার্ক ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কমেন্ট বক্স