আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে সারাদেশে বসবে ৪ সহস্রাধিক পশুর হাট। এসব হাটের মধ্যে বিভিন্ন মহাসড়কের পাশে ২১৭টি অস্থায়ী পশুর হাট ইজারা দিয়েছে সরকার। সরকার বলছে, পশুর হাট সড়ক ও মহাসড়কের পাশে বসানো যাবে না। পশুর হাটের কারণে স্বাভাবিক যানচলাচল ব্যাহত হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিয়েছে, পশুবাহী গাড়িতে তাদের গন্তব্যস্থল বা কোন হাটে যাবে সেই হাটের নাম গাড়ির সামনে লিখে রাখতে হবে। যাতে নির্দিষ্ট জায়গা ব্যতীত অন্য স্থানে দাঁড়াতে না পারে। মূলত কোরবানির পশুর হাটে শৃঙ্খলা আনতে এসব উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
জানা গেছে, এবার রাজধানীর ২০ স্থানে কোরবানির পশুর হাট বসবে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় বসবে ১১টি অস্থায়ী পশুর হাট, আর উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসতে যাচ্ছে ৯টি অস্থায়ী পশুর হাট। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের গাবতলী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সারুলিয়া এই দুটো স্থায়ী হাটেও কেনাবেচা হবে কোরবানির পশু।
সব মিলিয়ে কোরবানির ঈদের আগে রাজধানীতে পশুর হাটকেন্দ্রিক এক চরম ব্যস্ততার সৃষ্টি হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গরু ও ছাগলসহ নানান পশু রাজধানীর হাটগুলোয় বিক্রির জন্য নিয়ে আসা হয়। ক্রেতা-বিক্রেতাদের সরব উপস্থিতিতে গরম হয়ে ওঠে পশুর হাটগুলো। প্রতি বছর এসব হাটে খামারিদের থাকা-খাওয়া, নিরাপত্তা ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়।
যদিও সরকার বলছে, এবার কোরবানির পশুর হাটে কোনো অব্যবস্থাপনা থাকবে না। সড়কে যানজটও সৃষ্টি হবে না। আর তাই ভোগান্তিও পোহাতে হবে না সাধারণ জনগণকে।
তবে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশুর হাটে ব্যবস্থাপনা রাখাই এবার কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে। কারণ বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব থাকে।
তারা আরও বলেন, কোরবানির পশুর হাট ঢাকা সিটির বাইরে হলেই ভালো হয়। তাহলে বেশির ভাগ অব্যবস্থাপনা আপনাআপনি দূর হবে। অব্যবস্থাপনা বলতে যত্রযত্র গরুর গাড়ি রাখা এবং গরু রাখা, ট্রান্সপোর্টেশনে সরকারের নির্দেশনা না মানার কারণে যানজট তৈরি, প্রতিদিনের বর্জ্য প্রতিদিন না সরানোর কারণে দুর্গন্ধসহ পকেটমারের মতো কিছু সমস্যা আছে। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো জরুরি।
গাবতলী হাটে কোরবানির পশু নিয়ে আসা বেপারিরা বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজধানীর পশুর হাটে বিক্রির লক্ষ্যে আনা বিভিন্ন পশু পরিবহনের জন্য বিভিন্ন সেক্টরে পর্যায়ক্রমে টাকা দিয়ে আসতে হয়। তার ওপর ইজারা মূল্য বেড়ে গেলে ইজারাদাররাও মাশুল বাড়িয়ে দেন। এসব অতিরিক্ত টাকা তো ব্যবসায়ীরা নিজের পকেট থেকে দেন না। তারা পশুর দাম বাড়িয়ে বাড়তি টাকা আদায় করেন।
গাবতলীর পশুর হাটে আসা মোখলেস বেপারি নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, রাজধানীর সব হাটেরই বড় সমস্যা মশা। গেলো বার খড় পুড়িয়ে মশা তাড়ানোর চেষ্টা করেছি। টয়লেটের ব্যবস্থা থাকে না। এবার হাট কর্তৃপক্ষ কী করবে দেখা যাক। মশার উৎপাতে গরু আর মানুষ উভয়েরই টিকে থাকা দায় হয়ে পড়ে। গরমে পর্যাপ্ত ফ্যান পাওয়া যায় না। শুধু রাস্তায় যানজট নিরসন করলেই হবে না, হাটের ভেতরের সমস্যাগুলো দেখতে হবে।
এদিকে আসন্ন কোরবানিকে সামনে রেখে সড়কে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে সড়ক বিভাগ। অতীতে দেখা গেছে, পশুর হাটের ফলে রাজধানীতে মহাসড়কের স্থানে স্থানে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। তাই যাত্রীদের যাতায়াত নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে এবার মহাসড়কের পাশে এসব পশুর হাট না বসানোর নির্দেশনা দিয়েছে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ। সংস্থাটি বলছে, মহাসড়কে পশুর হাট বসানো ফলে যানজট সৃষ্টি হয়। যত্রতত্র পশু বহনকারী গাড়ি থেমে পশু উঠানো-নামানো ও বিক্রির কারণে তীব্র যানজটের সম্মুখীন হয় ঈদে বাড়ি ফেরা যাত্রীরা। যাতে ভোগান্তি সৃষ্টি না হয় সেক্ষেত্রে কোরবানির পশুবাহী যানবাহন পারাপারে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং টোলপ্লাজায় সার্বক্ষণিক ইটিসি বুথ চালু রাখারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পণ্য ও পশু পরিবহনকারী যানবাহনে যাত্রী বহন না করাসহ কোরবানির পশু পরিবহনকারী যানবাহনের সামনে ব্যানার ব্যবহার করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
তথ্যসূত্র বলছে, সিটি করপোরেশন ও মহানগর জেলাগুলোসহ সারা দেশে ৪ হাজার ৪০৭টি পশুর হাট বসবে। রাস্তার ওপর পশুর হাটে তারা কোনো পশু নামাতে পারবে না, রাস্তায় দাঁড়াতে পারবে না। তাদের জন্য নির্দিষ্ট স্থান আছে, সেখানেই তারা পশু নামাবে। ঈদযাত্রায় সড়ক-মহাসড়কে এবং শহর এলাকায় যানজট নিরসনে হাইওয়ে পুলিশ জেলা পুলিশ সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করবে। যানজট নিরসনে ব্যবহার করা হবে ড্রোন। মহাসড়কে সিসি ক্যামেরা বৃদ্ধিসহ যানজট নিরসনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করবে সরকার।
এছাড়া যানজটপ্রবণ এলাকায় ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে এর কারণ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুর্ঘটনা রোধে মহাসড়কে গাড়ির অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণে স্পিডগান ব্যবহার করবে পুলিশ। অতিরিক্ত গতিসম্পন্ন যানবাহনের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে আইনিব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্দেশনা
হাট ও পশু আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি বেশকিছু নির্দেশনা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। সংস্থাটি বলছে, কোরবানির পশুর হাটের বিষয়ে আয়োজকদের সঙ্গে বসতে হবে, তাদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে হবে যে, নির্ধারিত জায়গার এক ইঞ্চি বাইরেও যেন কোনো পশু না রাখা হয়। প্রয়োজনে হাটের জন্য নির্ধারিত এলাকা বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে। নিরাপত্তার জন্য কোরবানির পশুর হাটে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। যত্রতত্র কোরবানির পশু জবাই প্রতিরোধেও যথাযথ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি থাকতে হবে।
এছাড়াও কোনো রাস্তার ওপর পশুর হাট বসতে দেওয়া হবে না। কোরবানির পশুবোঝাই ট্রাক রাস্তায় দাঁড় করিয়ে পশু নামানো যাবে না। ট্রাফিকব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটালে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া হাটে রাত্রিকালীন ছবি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন সিসিটিভি স্থাপন, সিটি করপোরেশন কর্তৃক নির্ধারিত হারের বেশি হাসিল রাখা যাবে না এবং নির্ধারিত হাসিলের তালিকা বড় করে ব্যানারে প্রকাশ্য স্থানে লাগাতে হবে, পশুর হাটে জেনারেটরের ব্যবস্থা রাখা, পশুর হাটে ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করা, পর্যাপ্তসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা, জোর করে কোরবানির পশু হাটে নামাবেন না এমন কিছু নির্দেশনাও দিয়েছে ডিএমপি।
এদিকে আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশু পরিবহনে ক্যাটল স্পেশাল ট্রেন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। যাতে সড়কে খুব বেশি চাপ সৃষ্টি না হয়। পশ্চিমাঞ্চলে কোরবানির পশু পরিবহনের লক্ষ্যে ১২ থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত ক্যাটল স্পেশাল ট্রেন ১ ও ২ পরিচালনা করা হবে। পূর্বাঞ্চলে ১২ জুন ক্যাটল স্পেশাল ট্রেন ১ ও ২ এবং ১৩ জুন ক্যাটল স্পেশাল ট্রেন ১ পরিচালনা করা হবে।
ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। আশা করছি এবারের ঈদযাত্রা নিরাপদ হবে। নিরাপদ ও সুষ্ঠুভাবে ট্রেন পরিচালনা নিশ্চিত করে যাত্রীসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সময়ানুবর্তিতা রক্ষার জন্য ডিভিশনাল ও জোনাল কন্ট্রোলে পৃথক মনিটরিং সেল গঠন করে কর্মকর্তাদের ইমার্জেন্সি ডিউটি প্রদান করা হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী।
অন্যদিকে পশুর হাটে ক্রেতা-বিক্রেতাদের বিশেষ নিরাপত্তা দিতে হট লাইন নাম্বার চালু করেছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। যে কোনো রকম সমস্যার সম্মুখীন হলে জরুরি হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ কল করলে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (হটলাইন-১৬৩৫৮) চালু থাকবে।
মহাসড়কে বা যেখানে হাট বসালে যান চলাচল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন কিছু যাতে না হয় এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হবে। সড়কে বা সেতুতে কোরবানির পশুবাহী গাড়িকে প্রাধান্য দেওয়া হবে, যাতে রাস্তায় পশু আটকে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি না হয়। পশুর হাটে কোনো রকম সমস্য হলে হটলাইন নম্বরে কল করলে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কোরবানির পশুর শরীরে ক্ষতিকর উপাদান পরীক্ষায় সব সিটি করপোরেশনসহ দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পশুর হাটে এক হাজার মেডিকেল টিম নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। সূত্র জানায়, সব সিটি করপোরেশনসহ দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে গরুর হাটে এক হাজার ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম থাকবে। প্রতিটি টিমে একজন পশুচিকিৎসক ও আরো দুজন সহকারী থাকবেন। পশুচিকিৎসক দল হাটে একটি বুথে চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে অবস্থান করবেন। পশুর শরীরে ক্ষতিকর উপাদান পরীক্ষাসহ কোনো অসুস্থ প্রাণী পেলে তারা শনাক্ত করে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করবেন। মেডিকেল টিমগুলো কোরবানি ঈদের আগের দিন পর্যন্ত তিন দিন পশুর হাটে অবস্থান করবে। উপজেলা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি হাটে মেডিকেল টিম থাকবে।
জালনোট প্রতিরোধ ব্যবস্থা
কোরবানির পশুর হাটকে কেন্দ্র করে সারাদেশে জালনোট চক্রের তৎপরতা বেড়ে যায়। সেই অসাধু চক্রের তৎপরতাকে রুখতে প্রতিরোধে বুথ স্থাপনে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়ে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবারও শিগগিরই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানানো হবে এমনই জানা গেছে। সূত্র বলছে, বুথ স্থাপন করে হাট শুরুর দিন হতে ঈদের আগের রাত পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে পশু ব্যবসায়ীদের নোট যাচাই সংক্রান্ত সেবা দেওয়া হয়ে থাকে। বুথে নোট যাচাইকালে জালনোট ধরা পড়লে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশনা রয়েছে। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোর পৌরসভা ও থানার অনুমোদিত পশুর হাটে বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করে থাকে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্র থেকে জানা যায়, এবার পশুর হাটে ২৪ ঘণ্টা ব্যাংকিং সুবিধা থাকবে। জাল টাকা শনাক্তে বুথ থাকবে। এবার ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পশু বেচাকেনা করা যাবে। হাসিলও পরিশোধ করা যাবে অনলাইনে। এ বছর কোরবানিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে পশু বিক্রি হবে ৬০ হাজার কোটি টাকার এবং ২৫ লাখ পশু কোরবানি হবে।