ফুলের রাজ্য যশোরের ঝিকরগাছার গদখালী পানিসারার ফুলচাষিরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। আসন্ন কয়েকটি দিবসের বাজার ধরতে তাদের এই ব্যস্ততা। ভরা মৌসুমে চাষিরা শত কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন।
গদখালী ও পানিসারা অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, শীতের সকালে কুয়াশা ভেদ করে চাষীরা ফুলক্ষেতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রয়োজনমাফিক পানি দেয়া, স্প্রে করা, আগাছা নিড়ানো, মরা-রোগাক্রান্ত গাছ তুলে ফেলাসহ ক্ষেত পরিচর্যায় তাদের দম ফেলবার সময় নেই। পাশাপাশি ক্ষেত থেকে ফুল তুলে নিয়ে ছুটছেন গদখালি ফুলবাজারে।
দূর-দূরান্তের ক্রেতারাও হাজির হচ্ছেন সেখানে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণা আর হাঁকডাকে মুখরিত হয়ে উঠছে গোটা এলাকা। গোলাপ, রজনীগন্ধা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা ফুলের পসরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন শত শত ফুলচাষী।
কেউ ভ্যান, কেউ সাইকেল বা ঝুড়ির মধ্যে ফুল রেখে ঢাকা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে ফুলের দাম নিয়ে হাক-ডাকে ব্যস্ত। ফুলের চাহিদা বাড়তি থাকায় পাইকারি ব্যবসায়ীরা অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি ফুল কিনছেন এই বাজার থেকে।
একই সাথে বেশি দাম পাওয়ায় ফুল চাষীরাও বাজারে দ্বিগুণ ফুল এনেছেন। সবমিলিয়ে ফুল-বেচাকেনা জমে উঠায় ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীদের মনে এখন উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গদখালি বাজারে প্রতিটি গোলাপ বিক্রি হয়েছে ৪ থেকে ৫ টাকা দরে, প্রতি পিস রজনীগন্ধা বিক্রি হয়েছে ৬ টাকা। রঙিন গ্লাডিওলাস প্রতিটি মানভেদে বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৫ টাকা, জারবেরা বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৪ টাকা। ফুল বাঁধাইয়ের জন্য কামিনীর পাতা বিক্রি হয়েছে প্রতি আঁটি ৫০ টাকায়। জিপসির আঁটি বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকায়।
মালা গাঁথার জন্য চন্দ্রমল্লিকা বিক্রি হয়েছে প্রতি ১০০ ফুল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। গাঁদা ফুল বিক্রি হয়েছে প্রতি হাজার ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ফুলচাষিদের এখন দম ফেলার ফুরসত নেই। এই অঞ্চলে বছরজুড়ে ফুলচাষ হলেও ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচমাস ফুলের ভরা মৌসুম। সাধারণত শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, মহান বিজয় দিবস, খ্রিস্টিয় নববর্ষ, বসন্তবরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, মহান স্বাধীনতা দিবস ও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশে ফুলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে।
আর এসব দিবসকে টার্গেট করে গদখালীর চাষিরা ফুল আবাদ করে থাকেন। চলতি বছরের গ্রীষ্মে অতি তাপমাত্রা আর বর্ষার অতিবৃষ্টির ধকল কাটিয়ে এবার মৌসুমে চাষিরা শতকোটি টাকার ফুল বিক্রির স্বপ্ন বুনছেন।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্যমতে, যশোরে প্রায় ৭ হাজার ফুলচাষি রয়েছেন। তারা অন্তত ১২শ’ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রকার ফুল চাষ করেন। ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী, পানিসারা, নাভারণ, নির্বাসখোলার বিভিন্ন মাঠে ব্যাপক পরিমাণে ফুল চাষ হয়ে থাকে।
বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, জিপসি, রডস্টিক, ক্যালেন্ডোলা, চন্দ্র মল্লিকাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুলের চাষ হচ্ছে। দেশের মোট চাহিদার অন্তত ৭০ ভাগ ফুল সরবরাহ করেন যশোরের গদখালী অঞ্চলের ফুলচাষিরা।
জারবেরা চাষি মঞ্জুরুল আলম বলেন, দুই বিঘা জমিতে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এ বছর সাত থেকে আট লাখ টাকার জারবেরা ফুল বিক্রির আশা করছেন তিনি। ফুল চাষি সুন্নত আলী দুই বিঘা জমিতে গোলাপ চাষ করেছেন। তিনি বলেন, এবছর অসময়ে বর্ষা হয়েছে। এখন জমিতে বাড়তি পরিচর্যা করছি। সামনের অনুষ্ঠানে দাম ভালো পেলে লাভ হবে।
আরেক চাষি সোহাগ হোসেন বলেন, দেড় বিঘা জমিতে রঙিন গ্লাডিওলাস চাষ করেছি। বৃষ্টিতে অনেক গাছ মারা গেছে। প্রতি বিঘায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। দাম ভালো না পেলে আমাদের ক্ষতি হয়ে যাবে।
আরো কয়েকজন ফুলচাষি জানান, চলতি বছরের গ্রীষ্মে বেশ কয়েকবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে যশোরে। সেই সঙ্গে বর্ষা ঘিরে ছিল অতিবৃষ্টির দাপট। এসব কারণে গদখালীতে ফুলচাষিদের ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তারা বর্তমানে ফুলক্ষেতে পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
ফুলচাষি ও বিক্রেতা মোমিনুর রহমান জানালেন, এখন যে দামে ফুল বিক্রি হচ্ছে, তা আর কয়েকদিন পরে কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি হবে। সারাদেশ থেকে পাইকাররা আসছেন। ফলে বসন্ত দিবস ও ভালবাসা দিবসসহ আসন্ন আরও কয়েকটি দিবসে ভাল দাম পাবেন ফুলচাষিরা। তাই এখন দম ফেলার ফুসরত নেই।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, করোনা ভাইরাস ও আম্পান ঝড়ে এই অঞ্চলের ফুল সেক্টরকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে কউঠে কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন ফুলচাষিরা। চলতি বছরও সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পর অসময়ে বৃষ্টিতে ফুলচাষিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
তবে খ্রিস্টিয় নববর্ষ, বিজয় দিবস, বসন্তবরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, মহান স্বাধীনতা দিবস ও বাংলা নববর্ষে ফুলের বাড়তি চাহিদার বাজার ধরার আশায় চাষিরা ফুলচাষ করেছেন। বাজার জমজমাট হলে শত কোটি টাকার ফুল বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, এখন আবহাওয়া অনুকূলে রয়েছে। ফলে পোকার আক্রমণও অনেক কম। এ কারণে ফুল বিক্রি করে চাষিরা লাভবান হবেন। ফুল চাষিরা এখন ক্ষেত পরিচর্যায় পুরোদমে ব্যস্ত সময় পার করছেন।