এস আলমের প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে নগদ এলসির মাধ্যমে পণ্য আনা হয়েছে। পণ্য বিক্রিও করা হয়েছে। কিন্তু এস আলম গ্রুপ ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করেছে। বাধ্য হয়ে ইসলামী ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনে এলসির দায় পরিশোধ করেছে। আর এজন্য এস আলমের নামে বাধ্যতামূলক ঋণ সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব ঋণের অর্থ সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে ফেরত দেয়ার কথা। কিন্তু এক বছরের মধ্যে ফেরত দেয়া হয়নি। বিশেষ বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আরো এক বছরের সময় দেয়া হয়েছে। দুই বছরও পার হয়ে গেছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা পরিপালন করা হয়নি। এভাবে পণ্য আমদানির দায় পরিশোধ না করায় এস আলমের নামে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব ঋণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনাও মানা হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় রয়েছে, দেশের বাইরে থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় আমানত এনে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঋণ দিতে পারবে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বিদেশী ৬টি ব্যাংক থেকে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আমানত এসেছে মাত্র ৮ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় মাত্র ৯৬০ কোটি টাকা। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করেছে ১৭৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। এই টাকার ১৮ হাজার কোটি টাকাই নিয়েছে এস আলম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আগের নির্দেশনায় বলা হয়েছিল অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে ঋণ বিতরণ করতে পারবে ২৫ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রার সমপরিমাণ। ওই হিসেবে ইসলামী ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করতে পারে ১৫ কোটি ২৪ লাখ সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা, যা স্থানীয় মুদ্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঋণ দিয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানা হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, পণ্য আমদানির সময় ইউপাস পদ্ধতিতে আমদানি করা হয়। পণ্য দেশে আসার পর বৈদেশিক মুদ্রায় তা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু পণ্য দেশে আসার পর এস আলম এলসির দায় পরিশোধ না করেই ওই পণ্য বিক্রি করে দিয়েছে। অর্থ পরিশোধ না করায় এস আলমের নামে বাধ্যতামূলক ঋণ সৃষ্টি করেছে ইসলামী ব্যাংক। অপর দিকে বিদেশী ব্যাংকের মাধ্যমে পুনঃঅর্থায়নের মাধ্যমে এলসি খোলা হয়েছিল। যেমন, বিদেশ থেকে কোনো পণ্য আমদানি করা হলো। ওই পণ্যের বিপরীতে বিদেশী কোনো ব্যাংক তিন মাসের জন্য বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দেয়া হলো। তিন মাসের মধ্যে গ্রাহক তা পরিশোধ করার কথা। কিন্তু এস আলম পণ্য দেশে এনে তা বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু বিদেশী ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেনি। আবার দেশীয় কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলেছিল এস আলম।
পণ্য দেশে আসার পর এস আলম তা বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু ওই ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেনি। এস আলমের দেশীয় ব্যাংকের ঋণও বাজার থেকে ডলার কিনে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে। এভাবে ইসলামী ব্যাংকের নামে ১৮ হাজার কোটি টাকা সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার দায় সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এ কাজে সরাসরি সহযোগিতা করেছিল এস আলমের পিএস আকিজ উদ্দিন, মিফতা উদ্দিন ও হাবিবুর রহমান। বর্তমানে হাবিবুর রহমানকে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে অবৈধভাবে ডিএমডি পদে পদোন্নতি দিয়ে এসআইবিএল থেকে অর্থ বের করার হাতিয়ার বানানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত ২৫ জুন পর্যন্ত এস আলম ভেজিটেবল ওয়েলের বিপরীতে ৩৭ কোটি ৮২ লাখ ডলার, ইনফিনিয়া সিনথেটিক ফাইবার লিমিটেডের বিপরীতে ৮৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার, এস আলম সুপার অ্যাডিবিয়াল ওয়েলের বিপরীতে ৫৩ কোটি ৬৬ লাখ ৫০ হাজার ডলার, এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের নামে ৩৪ কোটি ১৬ লাখ ৫০ হাজার ডলার, সেনচুরি ফুড প্রডাক্ট এর নামে ১ লাখ ৪০ হাজার ডলার, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলের নামে ২ কোটি ১৫ লাখ ডলার, সোনালী ট্রেডার্সের নামে ২২ কোটি ২৮ লাখ ডলার, ইউনিটেক্স কোমপজিশন মিলসের নামে ৪ লাখ ১০ হাাজর ডলার ঋণ সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান এস আলমের মালিকানাধীন বলে জানা গেছে। অপর দিকে এস আলম এক্সিম ব্যাংকের এলসির দায় পরিশোধ না করায় ইসলামী ব্যাংক থেকে ডলার কিনে দেয়া হয়েছে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার, জনতা ব্যাংকের পরিশোধ করা হয়েছে ৮ কোটি ১১ লাখ ডলার ও রূপালী ব্যাংকের পরিশোধ করা হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার ডলার। এসব ঋণ অফশোর ব্যাংকিং থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
বেশির ভাগ ঋণই ৭২০ দিন দিন অতিবাহিত হয়েছে। এর পর এসব ঋণ পরিশোধ করা হয়নি। নিয়মবহির্ভূত এসব ঋণ পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তাগিদ দেয়া হলেও তা পরিশোধ করা হয়নি।
বরং আকিজ উদ্দিনের ভয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এস আলমের বিরুদ্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিপরীতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমোদন দিয়ে তা নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এসব এলসির বিরুদ্ধে নিয়ম অনুযায়ী কোনো কমিশনও এস আলম ইসলামী ব্যাংকের পরিশোধ করেনি। এমনকি এসব ঋণের বিপরীতে কোনো সুদও পরিশোধ করা হচ্ছে। এস আলমের পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা গেলে ইসলামী ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার সংকট অনেকাংশেই কেটে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।